সমাজ সংস্কারে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের ভূমিকা বা অবদান (Social Reformer Ishwar Chandra Vidyasagar)

উনিশ শতকের ভারতবর্ষে যে কয়েকজন মনীষী জন্মগ্রহন করেন তাঁদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন পণ্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। তিনি ছিলেন উনিশ শতকে বাংলার নবজাগরণের অন্যতম পথিকৃৎ। কুসংস্কার দূর করে সমাজ সংস্কারের কাজে তিনি নিজের জীবন ও কর্মকে নিয়োজিত করেন। মাইকেল মধুসূদন দত্ত বলেছেন, “বিদ্যাসাগরের মনীষা প্রাচীন ঋষিদের মতো, কর্মদক্ষতা ইংরেজদের মত এবং হৃদয়বত্তা বাঙালির মতো।”
ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের সমাজ সংস্কার
কৌলীন্য প্রথার বিরোধিতা
তৎকালীন হিন্দু সমাজে প্রচলিত কৌলিন্য প্রথার ফলে কুল রক্ষার উদ্দেশ্যে বহু পিতা-মাতা তাদের বালিকা কন্যাকে খুব বয়স্ক, এমনকি বৃদ্ধের সঙ্গে বিবাহ দেন এর ফলে ভবিষ্যতে হিন্দু নারীর জীবনে সীমাহীন দুর্দশা নেমে আসত। তিনি এই কৌলিন্য প্রথার বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ জানান। কৌলিন্য প্রথার সুযোগ নিয়ে কুলীন ব্রাহ্মণ কিভাবে নারীদের সর্বনাশ করছে তা তিনি হুগলি জেলার 133 জন ব্রাহ্মণের বৈবাহিক সম্পর্কের তালিকা তৈরি করে প্রমাণ দেয়।
বিধবাবিবাহ প্রবর্তনে উদ্যোগ
বিধবা নারীদের জীবনের করুণ দশা বিদ্যাসাগরকে খুবই ব্যথিত করে। তিনি হিন্দুশাস্ত্র বিশেষত ‘পরাশর সংহিতা’ থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে প্রমাণ করার চেষ্টা করেন যে, বিধবা বিবাহ শাস্ত্রসম্মত। তিনি বিধবা বিবাহের সমর্থনে ব্যাপক প্রচার শুরু করেন এবং আন্দোলন গড়ে তোলেন। তা ছাড়া দরিদ্র বিধবাদের সহায়তার উদ্দেশ্যে তিনি 1872 খ্রিস্টাব্দে ‘হিন্দু ফ্যামিলি অ্যানুইটি ফান্ড’ গঠন করেন।
বিধবাবিবাহ আইন পাস
বিধবা বিবাহ প্রচলিত হওয়া উচিত কি না এ বিষয়ে বিদ্যাসাগর 1855 খ্রিষ্টাব্দে দুটি পুস্তিকা রচনা করেন। এক বছরের মধ্যেই পুস্তিকা দুটির ইংরেজি অনুবাদ প্রকাশিত হয়। তার উদ্যোগে বিধবা বিবাহের প্রতি সমর্থন জানিয়ে 1855 খ্রিষ্টাব্দের 4 অক্টোবর 1 হাজার ব্যক্তির স্বাক্ষরিত একটি আবেদনপত্র সরকারের কাছে পাঠানো হয়। শেষপর্যন্ত বিদ্যাসাগরের প্রচেষ্টায় বড়োলাট লর্ড ডালহৌসি 1856 খ্রিস্টাব্দে 26 শে জুলাই 140 নং রেগুলেশন দ্বারা বিধবা বিবাহ আইন পাস করেন।
বিধবাবিবাহের আয়োজন
বিদ্যাসাগরের উদ্যোগে সংস্কৃত কলেজের অধ্যাপক শ্রীশচন্দ্র বিদ্যারত্ন 1856 খ্রিস্টাব্দে বর্ধমান জেলার পলাশডাঙ্গার ব্রহ্মানন্দ মুখোপাধ্যায়ের 10 বছরের বিধবা কন্যা কালীমূর্তি দেবীকে বিবাহ করেন। বিদ্যাসাগর নিজ পুত্র নারায়ণচন্দ্রের সঙ্গে অষ্টাদশী বিধবা ভবসুন্দরীর বিবাহ দেন। বিদ্যাসাগর 1856 থেকে 1867 খ্রিস্টাব্দের মধ্যে নিজের উদ্যোগে 82 টাকা ব্যয় করে 60 জন বিধবার বিবাহ দেন।
বাল্যবিবাহের বিরোধিতা
উনবিংশ শতকে ভারতের হিন্দু সমাজে বাল্যবিবাহের প্রকোপ ছিল। বাল্যবিবাহের অভিশাপ থেকে সমাজকে মুক্ত করার উদ্দেশ্যে বিদ্যাসাগর সর্বশুভকরী সভার মুখপাত্র সর্বশুভকরী পত্রিকার প্রথম সংখ্যাতেই ‘বাল্যবিবাহের দোষ’ নামে একটি প্রবন্ধ প্রকাশ করেন। সোমপ্রকাশ পত্রিকায় লেখা হয় বাল্যবিধবাদের দুঃখ মোচনের জন্য বিধবা বিবাহের উদ্যোগ নেওয়া হয়। বিদ্যাসাগর বাল্যবিবাহের বিরুদ্ধে জোরালো প্রচার শুরু করেন। এর ফলে ব্রিটিশ সরকার আইন প্রণয়ন করে মেয়েদের বিবাহের সর্বনিম্ন বয়স 10 বছর ধার্য করে দেয়।
বহুবিবাহের বিরোধিতা
বিদ্যাসাগর বহুবিবাহ প্রথার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ও আন্দোলন গড়ে তোলেন। তিনি বর্ধমানের মহারাজার সহায়তায় বহুবিবাহ প্রথার বিরুদ্ধে 50 হাজার ব্যক্তির স্বাক্ষর সম্বলিত একটি প্রতিবাদপত্র ব্রিটিশ সরকারের কাছে পাঠান। বহুবিবাহ বন্ধের উদ্দেশ্যে আইন প্রণয়ন করার জন্য ব্রিটিশ সরকার বিদ্যাসাগর সহ কয়েকজন বিশিষ্ট ব্যক্তিকে নিয়ে একটি কমিটি গঠন করেন। কিন্তু ইতিমধ্যে 1857 খ্রিস্টাব্দে ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে মহা বিদ্রোহ সংঘটিত হওয়ার পর সরকার হিন্দুদের সামাজিক প্রথায় হস্তক্ষেপ থেকে বিরত থাকার সিদ্ধান্ত নেয়। ফলে বহুবিবাহ বন্ধের বিষয়টি আর বেশিদূর এগোয়নি। বিদ্যাসাগর পরবর্তীকালে বহুবিবাহের বিরুদ্ধে দুটি পুস্তিকা প্রকাশ করেন এবং প্রমাণ করার চেষ্টা করেন যে, বহুবিবাহ অশাস্ত্রীয়। তার প্রচার ও শিক্ষাবিস্তারের ফলে বহুবিবাহের প্রকোপ বহুলাংশে হ্রাস পায়।
অন্যান্য সংস্কার
বিদ্যাসাগর তৎকালীন বিভিন্ন সামাজিক কুসংস্কার ও কুপ্রথার বিরুদ্ধে সরব হন। তিনি গঙ্গাসাগরে সন্তান বিসর্জন, কুষ্ঠরোগী হত্যা, অস্পৃশ্যতা, জাতিভেদ প্রথা প্রভৃতি কুপ্রথার বিরুদ্ধে সোচ্চার প্রতিবাদ করেন।
মূল্যায়ন
উনিশ শতকে বাংলার নবজাগরণের যাদের অসামান্য অবদান রয়েছে তাদের মধ্যে সর্বাধিক উল্লেখযোগ্য হলেন ঈশ্বরচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়।
আরো পড়ুন – সমাজ সংস্কারে ডিরোজিওর অবদান বা ভূমিকা