জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের গঠন ও কার্যাবলী

ভূমিকাঃ রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচনার একটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিষয়বস্তু হলো মানবাধিকার। রাষ্ট্রের বৈধতা এই অধিকার রক্ষার উপর নির্ভর করে। মানবাধিকার বলতে সেই সমস্ত অধিকার গুলি বোঝায় যেগুলি জন্মগতভাবে মানুষ ভোগ করে এবং মানব সমাজের একজন সদস্য হিসেবে প্রতিটি ব্যক্তি ভোগ করে। মানবাধিকার হল মানব জীবনের অমূল্য সম্পদ। কারণ ব্যক্তির বিকাশের জন্য কতগুলি সুযোগ সুবিধা থাকা প্রয়োজন। এই সুযোগ সুবিধাই ব্যক্তির পূর্ণ বিকাশ ঘটাতে সক্ষম হয়। তাই ব্যক্তির পূর্ণাঙ্গ বিকাশের জন্য নির্দিষ্ট কিছু অধিকার তথা মানবাধিকার মানুষের থাকা একান্ত প্রয়োজন। ভারতবর্ষ একটি গণতান্ত্রিক দেশ। আর গণতন্ত্রের মূল নীতি হল মানুষের পূর্ণ বিকাশ। আব্রাহাম লিংকনের মতে গণতন্ত্র হলো মানুষকে বিকশিত করার মূলমন্ত্র। এই বিকাশ ঘটাতে গেলে মানবাধিকার সংরক্ষণ করতে হবে। সম্মিলিত জাতিপুঞ্জ ও এই কারণেই মানবাধিকার রক্ষার শপথ নিয়েছে। ঠিক একইভাবে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে মানবাধিকার রক্ষার জন্য হয়েছে লড়াই ,গড়ে উঠেছে সংগঠন। ভারতবর্ষও এর ব্যতিক্রম নয়। মানব সভ্যতার পরিপূর্ণ বিকাশ ঘটানোর উদ্দেশ্য নিয়ে ভারতের জাতীয় মানবাধিকার কমিশন গড়ে উঠেছে। এই মানবাধিকার কমিশন ভারতবাসীর মানব অধিকার রক্ষার্থে দিবারাত্রি কাজ করে চলেছে।

ভারতের জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের পটভূমি

সম্মিলিত জাতিপুঞ্জের গৃহীত প্রস্তাব অনুযায়ী ভারতে মানবাধিকার কমিশন গঠনের উদ্যোগ লক্ষ্য করা যায়। সেই অনুসারে 1993 খ্রিস্টাব্দে 27শে সেপ্টেম্বর রাষ্ট্রপতি এক অর্ডিন্যান্স জারি করে নেশনাল কমিশন অন হিউম্যান রাইটস নামে একটি কমিশন গঠনের কথা ঘোষণা করেন। এই ঘোষণায় জাতীয় পর্যায় ছাড়া রাজ্য পর্যায়ে মানবাধিকার কমিশন গঠনের কথা বলা হয়। তাই এই অর্ডিন্যান্সের ভিত্তিতে 1993 খ্রিস্টাব্দে 10 ডিসেম্বর লোকসভায় প্রটেকশন অফ হিউম্যান রাইটস বিল পাস হয়। এই বিল রাষ্ট্রপতির সম্মতি পেলে 1994 এর 8 ই জানুয়ারি প্রটেকশন অফ হিউম্যান রাইটস অ্যাক্ট নামে আইন তৈরি হয়। এই আইন বলে জাতীয় মানবাধিকার কমিশন এবং রাজ্য মানবাধিকার কমিশন গঠিত হয় ভারতে। এই মানবাধিকার কমিশন গঠনের শুরু থেকে আজও পর্যন্ত ভারতবাসীর মানবাধিকার রক্ষা করে চলেছে সগর্বে।

জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের গঠন

প্রটেকশন অফ হিউম্যান রাইটস অ্যাক্ট 1994 এর II থেকে IV ধারায় জাতীয় মানবাধিকার কমিশন সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে। এই আইনের II ধারা থেকে 3 নম্বর উপধারায় বলা হয়েছে কেন্দ্রীয় সরকার এই কমিশন গঠন করবে। এই কমিশনের সদস্য সংখ্যা হবে আট। সুপ্রিম কোর্টের প্রাক্তন প্রধান বিচারপতি এর চেয়ারম্যান হবেন। এই কমিশনের অন্যান্য সদস্যরা হবেন সুপ্রিম কোর্টের একজন কর্মরত অথবা অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি, একজন কর্মরত অথবা অবসরপ্রাপ্ত হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি, মানবাধিকার সম্পর্কে বিশেষজ্ঞ দুজন ব্যক্তি, সংখ্যালঘু কমিশনের প্রধান, তপশিলি জাতি ও উপজাতি কমিশনের প্রধান এবং মহিলা কমিশনের প্রধান। মানবাধিকার কমিশনের গঠন বিশেষ দৃষ্টিভঙ্গি থেকে করা হয়েছে। সমাজের প্রায় সর্বস্তরের প্রতিনিধিরা এবং নিরপেক্ষ ব্যক্তিবর্গরা এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে। যার ফলে সামগ্রিকভাবে এই কমিশনের কার্যকারিতা আরো ফলপ্রসূ হয়েছে। যা ভারতবাসীর পক্ষে মঙ্গলজনক।

নিয়োগ ও কার্যকাল

ভারতের রাষ্ট্রপতি জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সদস্যদের নিয়োগ করে থাকেন। এই সদস্যদের কার্যকাল পাঁচ বছর। 70 বছর বয়স পর্যন্ত কাজ করতে পারেন সদস্যরা। যদি কোনো সদস্য দেউলিয়া ও উন্মাদ হন কিংবা কর্ম সম্পাদনে অসমর্থ হন কিংবা সদস্য থাকাকালীন অন্যত্র চাকরি করে অর্থ উপার্জন করেন তখন রাষ্ট্রপতি তাকে অপসারিত করতে পারবেন।

কমিশনের কার্যাবলী পর্যালোচনা

সুপ্রিম কোর্টের প্রাক্তন প্রধান বিচারপতি শ্রীরঙ্গনাথ মিশ্রের নেতৃত্বে প্রথম কমিশন গঠিত হয়। 1993 সালে নভেম্বর প্রথম সভা অনুষ্ঠিত হয়। এরপর মানবাধিকার লংঘনের অভিযোগ আসতে শুরু করে। এই অভিযোগের সংখ্যা দিন দিন বৃদ্ধি পেতে থাকে। একটি সমীক্ষায় দেখা যাচ্ছে 1993-94 সালে অভিযোগে শংখ্যাছিল 496 টি। 1998-99 সালে সেই সংখ্যা দাঁড়ায় 46724 টি-তে। কমিশনের কার্যাবলী পর্যালোচনা করলে দেখা যায় কমিশনের পক্ষে সমস্ত অভিযোগের অনুসন্ধান করা সম্ভব হচ্ছে না। এ কারণে যে সমস্ত ঘটনা ঘটার এক বছরের বেশি পরে অভিযোগ এসেছে কিংবা যেসব মামলা বিচারাধীন আছে কিংবা যে সব ঘটনার মধ্যে অস্পষ্টতা আছে অথবা যেসব ঘটনা অত্যন্ত তুচ্ছ সেগুলির দায়-দায়িত্ব কমিশন নিচ্ছে না। অভিযোগের সংখ্যা বৃদ্ধি পেলেও কমিশন সমস্ত অভিযোগের শুনানি করতে পারছে না। এক্ষেত্রে যেমন সময়ও কম তেমনি কমিশনের সদস্য সংখ্যাও কম। সঠিক বিচারের জন্য যে সময় প্রয়োজন হয় কমিশনের হাতে তা নেই। কারণ মামলার সংখ্যা বা অভিযোগের সংখ্যা অত্যন্ত বেশি। 1997-98 সালে অভিযোগে সংখ্যা ছিল 36791। পাশাপাশি পূর্বের বকেয়া অভিযোগ ছিল চার হাজারেরও বেশি। অর্থাৎ 1997-98 সালে সর্বমোট অভিযোগে সংখ্যা দাঁড়ায় 40801টিতে। এগুলির মধ্যে কমিশন 27289 টি অভিযোগের অনুসন্ধান করার ব্যবস্থা নেয়। এরমধ্যে 13512 টি অভিযোগের শুনানি হয়। অভিযোগের সংখ্যা দিন দিন যেভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে তাতে এটি স্পষ্ট যে মানবাধিকার লঙ্ঘনের মাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছে আর সেইসঙ্গে কমিশনের প্রতি মানুষের আস্থা বৃদ্ধি পাচ্ছে। কারণ ভারতীয় নাগরিকরা মানবাধিকার কমিশনের উপর আস্থা রেখেছে বলেই এত অভিযোগ নিয়ে আসছে তারা।

সমালোচনা

ভারতীয় নাগরিকদের মানবাধিকার রক্ষার জন্য যে জাতীয় মানবাধিকার কমিশন গড়ে উঠেছে তা নিঃসন্দেহে সদর্থক ভূমিকা গ্রহণ করে। কিন্তু এ সত্বেও কিছু সমালোচনা থেকেই যায়। যেমন- ১) অতিরিক্ত অভিযোগের কারণে কমিশনের পক্ষে প্রতিটি অভিযোগ দেখার ও বিচার করার সুযোগ হচ্ছে না। এর ফলে কমিশনের ওপর জনগণের বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা যাচ্ছে। ২) অভিযোগ প্রতিকারের জন্য জাতীয় মানবাধিকার কমিশনকে রাজ্যের সহযোগিতা করা দরকার। কিন্তু অনেক সময় দেখা যায় সকল রাজ্য সরকার সঠিকভাবে বা সদর্থক ভাবে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনকে সাহায্য বা সহযোগিতা করছে না। ৩) কমিশন কোন অভিযোগ সম্পর্কে অনুসন্ধান করে তথ্য সংগ্রহ করে মানবাধিকার লঙ্ঘনকারী বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে কর্তৃপক্ষের কাছে সুপারিশ করতে পারে। কিন্তু কমিশন নিজে কোন শাস্তি দিতে পারে না। এক্ষেত্রে কমিশনের ক্ষমতা কিছুটা সীমাবদ্ধ হয়ে পড়েছে।

মূল্যায়ন

তবে এই সামান্য সীমাবদ্ধতা থাকা সত্ত্বেও ভারতে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের গুরুত্বকে কখনোই অস্বীকার করা যায় না। 130 কোটি জনগণের দেশ ভারতবর্ষে প্রতিনিয়ত কোথাও না কোথাও জনগণের মানবাধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে। এই মানবাধিকার রক্ষার জন্য জাতীয় মানবাধিকার কমিশন উচ্চ স্তরে যে ভূমিকা পালন করে আসছে তা নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয়। কারণ এই মানবাধিকার কমিশন না থাকলে সুবিধাভোগী ও স্বার্থান্বেষী উচ্চবিত্ত শ্রেণি নিম্নবিত্ত শ্রেণীকে শোষণ করে নিজেদের স্বার্থ পূরণ করত আর নিম্নবিত্ত শ্রেণীর মানবাধিকার লঙ্ঘিত হতো। বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন মানবাধিকার রক্ষা সংক্রান্ত কাজ করে চলেছে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের ছত্রছায়ায়। এভাবে সর্বোপরি ভারতীয় নাগরিকদের অধিকার রক্ষা করা কিছুটা হলেও সম্ভবপর হচ্ছে। তবে মানবাধিকার কমিশনের সংগঠনকে আরো সুদৃঢ় করতে হবে। পাশাপাশি এর সদস্য সংখ্যা বৃদ্ধি ও কেন্দ্রের সংখ্যা বৃদ্ধি করতে হবে। যাতে খুব সহজেই ভারতীয় নাগরিকরা তাদের অধিকার রক্ষার দাবি নিয়ে পৌঁছতে পারে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের দরবারে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button
close